Wednesday, 25 October 2017

ভেরেন্ডা ভাজা


সুমন
    মানে কি জানো? সুন্দর মন। ভাবছো একজন মানুষের নাম সুমন হলেই মনও সুন্দর হবে। তবে আমি জানি না এমন হয় কি না। আমি যার কথা বলতে যাচ্ছি সে মোটেই সুন্দর মনের অধিকারী নয়। পুরাই ভেরেন্ডা ভাজা মানে তার পশমের গোঁড়ায় গোঁড়ায় শয়তান। প্রতিটা ব্যাপারে তার শয়তানী বুদ্ধি চাই ই চাই। তাকে বাজিয়েছ তো মরেছ

স্কুলের খাতায় সুমন নাম লেখা থাকলেও ক্লাসে সবাই তাকে ভেরেন্ডা ভাজা নামে চিনে। তার মুখে গাল গল্প আর বাজে কথা ছাড়া কখনও কেউ ভালো কিছু শুনে নাই। হুট করে একদিন ক্লাসের ফাষ্ট বয় তপু কি মনে করে তাকে ‘ভেরেন্ডা ভাজা’ ডাকে আর ওই দিন থেকেই সুমনকে এক নামে ছিনে সবাই- ‘ভেরেন্ডা ভাজা’। নিজের এমন নাম শুনে সুমন দমে যাওয়ার পাত্র নয়। রাগে ক্ষোভে তার সাদা বদনখানা লালচে বর্ন ধারন করেছে। হুট করে শাঁই করে ছুঁড়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা তপুকে এক চড় বসায় গালেচড় খেয়ে তপু তালগোল পাকিয়ে বারান্দার মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। মেঝে থেকে উঠে আরেকটা ফিরতি চড় দেয়া বা চোখ তুলে তাকাবার সাহস বা শক্তি কোনটাই তপুর হয় নাই। তপু ক্লাসের ফাষ্ট বয় হলেও শরীর স্বাস্থের দিক থেকে ক্লাসের সর্বশেষ অবস্থানে রয়েছে সে অন্যদিকে ক্লাসের লাষ্ট বয় হলেও সুমনের শরীরের অবস্থা ক্লাসে সবার উপরেতার বদ মেজাজ আর পেশী শক্তির কারনে কেউ তাকে এমন ঘাটায়ও না। তারপরেও কিভাবে যে সুমন সবার মধ্যে গিট্টু মেরে দূর থেকে মজা লুটায়।

একবার হয়েছে কি, আমি ক্লাসের লাষ্ট বেঞ্চে বসে আছি। ওদিকে স্যার অংক বুঝাচ্ছে। অংকের ব্যাপারে আমিও সুমনের মতো উদাসীন যদিও সুমন সব বিষয়েই উদাসীন। যাইহোক, সুমন সামনের বেঞ্চিতে বসা রিয়াদের সিটের দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি সুমনের দিকে। সুমনের পাশাপাশি বসায় আমারও দেখতে অসুবিধে হচ্ছে না সুমন কি দেখছে। এতোক্ষন রিয়াদ বেঞ্চে হাত দিয়ে রেখে সামনে তাকিয়ে অংক বুঝছে, যেই সে হাতটা গালে দিয়ে ভাবুকের মতো করে অংক বুঝার চেষ্টা করছে ঠিক তখনই সুমনের চোখ পরলো দু লাইনের লেখায়আমি একবার লেখায় একবার সুমনের চোখে তাকিয়ে রয়েছিলেখা পড়ে সুমনের চেহারার যা হলো! চোখে মুখে ক্রোদ আর হিংস্রতা ছাড়া কিছুই না।

‘ভেরেন্ডা ভাজা, নয় তাজা  
যেও না খেতে, ক্ষত হবে পেটে”

একবার ভাবুন এমন কবিতার মতো করে লেখা দেখে সুমনের ক্রো না হওয়ার উপায় আছে। শুধু কি সুমনের, দেখে আমারও যে শরীরটা জ্বালা ধরেছে। কি যে বিচ্ছিরি লেখার ঢং। নির্ঘাত এই কাজ রিয়াদ ছাড়া কেউ করে নাই। ক্লাসের লাষ্টবয় কি ফাষ্ট বয় এমন কি সব স্যাররাও জানেন এ ক্লাসে কে কবিতা লেখে, কেমন কবিতা লেখে। একবার হয়েছি কি, জেলা থেকে বড় বড় অফিসাররা এসেছে আমাদেরকে উঁচু স্তরের জ্ঞান দিতেতাদের মধ্য থেকে একজন হুট করে জিজ্ঞেস করেন-

‘তোমাদের মধ্যে কেউ কবিতা- টবিতা লিখে কিনা?’  

এ কথা শুনতেই এক নামে সবাই চিৎকার দিয়ে উঠে, ‘স্যার রিয়াদ ভালো কবিতা লিখতে পারে’।
স্যারও কম রসিক না- তিনি বলেন।

‘ ত! বাবা রিয়াদ, শুনাও না তোমার একটা কবিতা, শুনে যেন হই আমি মুগ্ধ’

রিয়াদ স্যারের কথা শুনে উঠে দাঁড়ায়। কিছুক্ষন কি জেনো ভেবে মাথা চুলকিয়ে নিয়ে একটু গলা কেশে তারপর শুরু করে-  

‘ওগো গুরু কি দিয়ে করবো শুরু
চেয়েছিলে শুনতে একখানা কবিতা
শুনে যে হয়েছে মন গর্বে আপ্লুত
কি করে বুঝাই
কবিতা হয়েছে গত
দেখে আপনার মস্ত বদখানা’ 

এমন কবিতা শুনে সবাই যখন আনন্দে বাহবা, মারহাবা আর হাততালি দিয়ে যাচ্ছে তখন কবিতা শুনতে চাওয়া মশাই শুধু গোল আলুর মতো করে দাঁড়িয়ে আছেন। অন্য শিক্ষকেরা তার কাছে কবিতা কেমন হয়েছে শুনছে চাইলে সেও নিজের মান রক্ষার জন্যে বলে উঠেন-

‘ বাহ! বড়ই চমৎকার! এমন কবিতা আগে কখনও শুনি নাই’।

সবার এমন কম্পিমেন্ট শুনে রিয়াদ যেন সাত সমুদ্রে ভাসছে। তখন মনে মনে আমি ভাবলাম মশাই একটা কবিতা শুনতে চেয়ে কি না ধকলটাই যে সামলালেন। বড় বড় শিক্ষকরা যখন বিদেয় নিলেই তখন আমাদের ক্লাস শিক্ষক মাহাবুব রিয়াদকে সামনে ডাকলেন। সবার মতো আমিও খুশি স্যার রিয়াদকে এখন অভ্যর্থনা দিবেন কিন্তু হায় সব আমাদের মনের ভুল।
হতচ্ছাড়া!

এ কেমন কবিতা? নির্ঘাত ফাজলামু ছাড়া আর কিছু না’

এই বলেই মাহাবুব স্যার রিয়াদের পাছায় জোড়া বেত দিয়ে পিটা শুরু করলো। এমন দৃশ্য দেখে ক্লাসের কেউ চুপ না থেকে উপায় আছে বলো তোমরাই। এবার ভেবে দেখো, এর পর থেকে কেউ না চেনার উপায়, ‘কে কবিতা লিখে কার কবিতা ভুবন জুড়ানো জগত বিখ্যাত’

অন্য প্রতিদিনের মতো আমিও আজকে ক্লাসে। আজকেও আমার পাশে সুমন তার একটু দূরে রেশমি আর তার পাশে রিয়াদ। রেশমির সাথে রিয়াদের কিছু তো আছে না হলে প্রতিদিন রিয়াদ ও বা কেন তার কাছাকাছি বসতে চাইবেআচ্ছা, সে গল্প তোমরা পরে নিজের মাথা খাটিয়ে বের করে নিও, বের করতে না পারলে আমরা একটা ফ্রী উপদেশ, ‘তোমাদের আরো বেশী বেশী করে গল্পের বই পড়া উচিত’

আমি এখন ভেবে যাচ্ছি সুমনকে নিয়ে। রিয়াদের কবিতা কি শেষে তার মনে ধরেছে, প্রতিশোধ নেয়ার মতো আর কোন লক্ষনই চোখে পড়ছে না । না, সে আমার মনের ভুল। আমি সব সময় ভুল চিন্তাই করে যাই। আমার চিন্তা যে ভুল তা রেশমির চিৎকার শুনেই বুঝলাম। আজকে তবে রিয়াদের কপালে দুঃখই আছে।

‘কি হয়েছে, এতো চেচাচ্ছ কেনো, তুমি কি ভুলে গেছো এটা ক্লাস’

মুকুল স্যারের এমন কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্যেও রেশমি দমে যাওয়ার পাত্রি নয়। কাঁদো কাঁদো গলায় সে স্যারকে একটা চিরকুট দেয় যার গায়ে আঠা লেগে আছে, অল্প সল্প আঠা নয় আস্ত একটা চুইঙ্গাম যা রেশমি তার চুলে লেপ্টে থাকা জটলা থেকে বহু কষ্টে খুলছে। চুইঙ্গামের জটলাটা এতো বড় দেখে মনে হতে পারে ঢাকা শহরে কোন এক মহল্লায় জটলা পাকানো তারের কুণ্ডলী। এমন জটলা দেখে রেশমির মাথা খারাপের মতো অবস্থা। চুল কাটা ছাড়া এই জটলা খোলার উপায় নেই এই জন্যেই বৈকি রেশমির চিৎকার দেয়া।

চিরকুট মেলে মুকুল স্যারে সে কি হুঙ্কার, সাথে ডাক পড়লো রিয়াদের-

‘উঠে আসুন কবি সাহেব, খুব কবিতা লেখার ধুম ছেপেছে, আজকাল বাহারি বাহারি কবিতা তাহলে অন্যের চুলেও লেপ্টে দেয়া হচ্ছে’।

স্যারের এমন কথা শুনে রিয়াদ কিছুই বুঝে উঠতে পারে না শুধু হ্যা করে স্যারের সামনে তাকিয়ে থাকে। স্যারের এমন কথা শুনে কেউ কিছু না বুঝলেও আমি ঠিকই ধরেছি। মনে মনে বলি, তাহলে আমাদের ক্লাসে দ্বিতীয় কবিরও সন্ধ্যান মিলেছে। চিরকুটটা হাতে নিয়ে মুকুল স্যার কতো রঙ চং মাখিয়ে চটাং চটাং করে পড়া শুরু করেছে-

প্রিয় রেশমি, শুনো তবে মনদিয়ে
হয়েছি আমি যে প্রেমে দেওয়ানা
তোমার প্রেমেতে ডুবে মন যে চাচ্ছে তোমায়
তাই তো দিলাম লিখে তোমার কেশের মধ্যখানে,  
চিরকুটটা আঠা মেরে।
যদি নেও মেনে ভালোবাসা, জানিও নিরালায়
আছি বসে তোমার পাশে থাকবো এমন- আঠার মতো।
বুঝে নিও ভালোবাসা, থাকবে এমন- আঠার মতো।  
ইতি
তোমার ভালোবাসা
কবি
রি...।

এমন কবিতা শুনে ক্লাসের সবাই হু-হা করে হেসে যাচ্ছে পড়তে গিয়ে স্যারের গোঁফের ফাক দিয়েও হাসির চিলতে পরেছে। এমন কি মুখ গোমরা করে বসে থাকা রেশমিও স্যারের সূর মাখা চিরকুট পড়তে দেখে লুকিয়ে হেসেছে। সবাই হাসলেও বেচারা রিয়াদ একটুও হাসতে পারলো না। স্যার যতো পড়ে যাচ্ছে ওর মুখখানা ততো কালো হচ্ছে। উল্টো কবিতা শেষ হওয়াতে মনে হচ্ছে তার একটু সস্থি এসেছে। এতো হাসি ঠাট্টার মধ্যে থেকেও আমার চোখ একজনের নজরে থেকেছে, তাকেও খুব বেশী খুশি হতে দেখলাম না, তবে তার চোখখানা দেখে যে কারো অনুমান হবে, সে খুব শান্তই আছে। তবে তো ঘটনা মিলে যাচ্ছে। সুমনকে কখনও কেউ শান্ত থাকতে দেখেছে? সব সময়ই তো তার মধ্যে চিন্তায় অস্থিরতার রেখা খেলে।  

ক্লাস শেষে সবাই যখন বাড়ি যাচ্ছে তখনও রিয়াদকে মাঠে পাঁচটা ইট মাথায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার হাত, মুখ এখনো ফুলে আছে। মুকুল স্যার কতো নিষ্ঠুর ভাবেই না তাকে জোড় বেত দিয়ে পিটাতে পিটাতে ক্লাস থেকে বের করে মাঠে পাঠিয়েছে, জেনো মন্দিরে কুকুর ঢুকেছে এখন পিটিয়ে বের না করলে মন্দিরের জাত যাবেকঠিন শাস্তি হিসেবে মাথায় ইটও চেপেছে। এমন অবস্থা দেখে নির্ঘাত রেশমিরও মনে মায়া জমতে পারে কিন্তু সুমনের মনে নয়। ক্লাস শেষে সুমন রিয়াদের কাছ ঘেঁসেই বাড়ি পথে হাঁটা ধরে আর রিয়াদকে দেখে শীষ দেয় আর নিজে নিজে তাকে নিয়ে লেখা কবিতাটা পড়ে-
‘ভেরেন্ডা ভাজা, নয় তাজা
যেও না খেতে, ক্ষত হবে পেটে”

এমন অবস্থার পর নিশ্চয়ই রিয়াদেরও বুঝতে বাকি থাকলো না এ ঘটনা কে ঘটিয়েছে।


মুকুল স্যারের পিটুনি খাওয়ার আট মাস পরে রিয়াদের সাথে রেশমির প্রেম ঘটে। রিয়াদের ক্লোজ বন্ধু আর ক্লাসের ফার্ষ্ট বয় তপুর শত বুঝানোর পর রেশমি বুঝতে সক্ষম হয় তাকে নিয়ে লেখা কবিতাটা আসলে রিয়াদ লিখে নি, অন্য কেউ লিখেছে। রেশমিকে বুঝাতে সক্ষম হলে কথা ছিলো রিয়াদ তপুকে তিন দিন পেট পুজো করাবে। রিয়াদ তার কথা রেখেছে। তপুকে তিন দিন তার ইচ্ছে অনুযায়ী যা চেয়েছিলো তা ই খাইয়েছে।

তপু খাওয়ার ব্যাপারেও যথেষ্ঠ ফার্ষ্ট। একটু বেশী লোভীও। ক্লাসে সবার ভালো বলে সবাই তার কাছে নোট ধার চায়যে তাকে বেশী খাওয়ায় তাকেই সে নোট দেয়তপু যে খাবারের লোভী তা রেশমী কি সুমনও পর্যন্ত জানতো। সুমন ঠিক ঠাক পড়ার খবর না রাখলে কি হবে, ক্লাসের বাকি খবর ঠিকই রাখে। তপুর লোভ কে পুঁজি করেই সে এক সাপ্তাহের মধ্যে রিয়াদের প্রেমের রসায়নে গিট্টু বাজিয়ে দেয়। এমন গিট্টুই বাজিয়েছে তা থেকে রিয়াদ আর বের হতে পারে নাই। সুমন ফেসবুকে একটা ফেইক আইডি খুলে। ওই আইডি থেকে রেশমিকে দুটো তথ্য দেয়। প্রথমটা হলো চিরকুট ঘটিত কারনে তপুকে রিয়াদ ট্রিট দেয়। দ্বিতীয়টি হচ্ছে রিয়াদের সাথে অন্য মেয়ের ক্লোজ ছবি। প্রথম ঘটনার কাহিনী এতক্ষণে তোমাদের জানাদ্বিতীয় ঘটনা জানতে হলেও মন দিয়ে শুনতে হবে সামনে কি হচ্ছে, সুমন পড়াশুনা তেমন না করলে কি হবে তার বাবা বেশ অর্থশালী, কিছু চাওয়ার আগেই নিজ সন্তানের ইচ্ছে পূরন করেন। এই জন্যেই তার ইচ্ছে অনুযায়ী এই বয়সে তার বাবা তাকে একটা ল্যাপটপ কিনে দেনআমাদের ক্লাসে সুমন ছাড়া কারোই ল্যাপটপ নেই, ল্যাপটপ তো দূরের কথা হাতেগুনো কয়েক জনের মোবাইল আছে মাত্র। সব বাবা মায়ের এক কথা ছেলে তো মাত্র নাইনে উঠেছে এই বয়সে ওগুলো দিয়ে কি হবে। আচ্ছা বাবা মায়ের কিচ্ছা ছাড়া যাক, আসল ঘটনায় আসি। ল্যাপটপ আর ইন্টারনেটের দৌলতে সুমন এর  মধ্যে অনেক কিছু শিখেছে এবং এদিক থেকে ক্লাসে সে একাই সেরা, এ তথ্য আমি ছাড়া ক্লাসের অন্য কেউও জানে না। এতক্ষণে তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগে নি? আমি সুমনের এতো ভেতরের কথা কিভাবে জানি। আচ্ছা প্রশ্ন না জাগলেও চিন্তার কিছু নেই আমি ঘটনা শেয়ার করছি একটু ধৈর্য ধরে পড়তে থাকো। গত কয়েক মাসে কতো ঋতুরই পরিবর্তন ঘটেছে, শীত গেলে, বর্ষা গেলো আর কতো ঋতুই তো গেলো। এর মধ্যে সুমনের সাথে আমারও বেশ ভাব হয়ে গেলো। এই ভাব হওয়ার পিছেও একটা কারন রয়েছে। আমি সব সময় চেয়েছি ক্ষমতার আসে পাশে থাকতে। ‘দুর্বলরা ক্ষমতায় নিজেকে আঁকড়ে রাখতে চায়, সবলরা যোগ্যতায় নিজেকে গড়তে চায়’আমি জানি আমি সবল না, না পারি ভালো লেখাপড়া, না পারি ভালো মারামারি। তাই ভাবলাম মাঝামাঝি পড়ে থেকে কিছু হবে না, একটু চেষ্টা করলেও ভালো লেখাপড়া সম্ভব না। তাই নিজেকে সুমনের ছায়ায় নিয়ে আসলাম। যার সাথে চললে কোন বিপদও আমাকে ছুবে না, ক্লাসের কেউ কখনও উঁচু গলায় কথাও বলবে না। পরীক্ষার সময় কিছু দেখাতে বললে তাতেও বাঁধা দিবে না। এই ভাবে একদিন সুমনের কাছে চলে আসলাম।

আসল কথাই এখনো বলা হয় নাই। রিয়াদের সাথে অন্য মেয়ের ক্লোজ ছবির গল্প। ফটোশপ বলে একটা সফটওয়্যার আছে। যা দিয়ে রাতকে দিন আর দিককে রাত বানানো যায়। শুনে খুব তাজ্জব লাগছে তাই না? আমারও প্রথমে লেগেছে সুমনের মুখে শুনে, তখন মনে মনে বললাম শালার সাথে এতো ভাব হলো তারপরেও শালা আমাকে আপন ভাবতে পারছে না, আমার সাথে শুধু গুল মারে। পরে একদিন সুমন আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। আমার সামনে রিয়াদের একটা ছবি ফেসবুক থেকে ডাউনলোড করে আর আরেকটা মেয়ে-ছেলের ছবি তার ল্যাপটপের ফোল্ডার থেকে বের করে। ওই মেয়ে ছেলে দুটোই বয়সও আমাদের সমান। তারপর কাটাছেড়া করে ঐ মেয়ে ছেলের মধ্যে ছেলের মাথা সরিয়ে রিয়াদের মাথা বসায়। দেখে আমি হ্যা করে তাকিয়ে থাকি। আর তখন মনে হলো ও আমার সাথে গুল মারে নাই, আমার সন্দেহপ্রবন মন সব কিছুকেই গুল ভেবে নেয়। সুমন আমাকে চাট্টি মেরে বলে-

‘এমন হ্যা করে কি দেখছিস? দেখতো কিছু বুঝতে পারিস কিনা?  

আমি ‘অ্যাঁ’ করে উঠি।

নিজের সামনে এডিট করার পরেও যেখানে আমি ক্যাবলা বনে গেলাম সেখানে ছবিখানা দেখে রেশমির কি হালটাই হলো। নির্ঘাত রিয়াদকে টাউট-বাটপার ছাড়া আর কিছুই ভাবে নাই।

সুমন যে কি চিজ তা এতক্ষণে বহুবারই তো টের পেলে। আরেকটা ঘটনা বলি- যে ফেইক আইডি দিয়ে সে ফেসবুক খুলেছে তা আইডিটার নাম কি জানো? না তোমাদের তো জানার কথা না। ওটা আমার নাম, সুমন আমাকেও ছাড়লো না মানে আমার নামকে। আমার নামকে উল্টো করে আমার নামে সে ফেসবুক ফেইক আইডি বানায়। আমার অতো শক্তি নাই, থাকলে কতোবার যে তার কান ধরে হ্যাঁচকা টানা টানতাম এই কথাটা জানার পর।

‘রহিমা লসায়ফ’

নামটা ফেসবুকে এমন ই দেয়া আছে। তোমাদের কারো আমার নাম জানতে মন চাইলে উল্টো করে পড়ে নিও। যাইহোক এই আইডি থেকেই সুমন প্রতিদিন রেশমির সাথে চ্যাট করেএমন কয়েক মাস যাওয়ার পর রেশমির খুব ইচ্ছে জাগে সুমনের সাথে দেখা করার কিন্তু সুমন তো পড়লো ফাপড়ে। ফাপড়ে পরলে কি হবে যার কাছে আস্তো শয়তান আসতে ভয় করে আর এই মেয়ে তো কিছুই না শেষে সুমন মেয়েকে বুঝিয়ে বাজিয়ে বললো-

‘দেখো রেশমি সামনে আসলে তোমার আমাকে ভালো না ও লাগতে পারে। জগতে এমন অনেক ব্যাপার আছে দূর থেকে দেখতে সুন্দর কাছে আসলে অসুন্দর দেখায়’। 

এমন অনেক উপমা ব্যবহার করছে মেয়ের মন গলাতো যাতে না দেখা হোকতারপরেও মেয়ে দেখার জন্যে আকুল হয়ে আছে। কিছুতেই তাকে বুঝানো যায় না। শেষে মেয়ে কসম ছুঁড়ে দেয়-
‘তুমি যতো অসুন্দর যতো খারাপই হও না কেনো আমি তোমাকে ভালোবেসে যাবো, কসম দিয়ে বলছি তারপরেও দেখা করো। ভালোবাসা যেহেতু হয়েছে এখন লুকিয়ে ভয় পেলে হবে। সামনে আসো দেখা করো তুমি’ 

সুমন এতো দিনে এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। শেষে তাদের দেখা করার তারিখ ঠিক হলো। আমাকেও সুমনের সাথে যেতো হলো।  

আমি একটু দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি। রেশমি একবার ডানে একবার বামে তাকিয়ে আছে। সুমন ছাড়া আর কেউ নেই আর কেউ আশার ও লক্ষণ নেই। এমন কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সুমন নিজ থেকে বলে উঠে-
‘আর কেউ আসবে না, যার আসার কথা সে তো এসেছে’।
মানে...মানে......মানে, একবার না টানা তিন তিনবার মানে মানে করে গেলো রেশমি। আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি আর মজা পাচ্ছি।  
‘দেখো আমিই সেই ‘রহিমা লসায়ফ’ এই বলে রেশমির সামনে দাঁড়ায় সুমন।
এই কথা শুনে রেশমির চেহারার যে হাল হয়েছে। পাঠক তোমরা দেখলে নির্ঘাত খুব মজা পেতে।
মুহুর্তে রেশমি নিজেকে সামল দিয়ে বললো, ‘ঠিক আছে সুমন, যেহেতু আমরা সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেছি আর কসমও করেছি এখন চাইলেও তা আমরা ভাঙ্গতে পারবো না। আমি নির্দ্বিধায় তোমাকে মেনে নিলাম’।
এ কথা শুনে সুমন খুব খুশী হয়েছে। ও ভাবতেই পারে নি রেশমি এতো তাড়াতাড়ি তাকে মেনে নিবে। সুমন কেন আমিও তা ভাবতে পারি নাই। কতো অদ্ভুত ব্যাপার স্যাপার! 
‘তবে আমার একটা শর্ত আছে’ শর্তের কথা শুনে সুমন রেশমির দিকে তাকায় খুব আগ্রহ নিয়ে।
‘কি শর্ত’ সুমন জানতে চায়।
‘সুমন’ নামের অর্থ কি তুমি জানো সুমন? সুমন মাথা নেড়ে ‘না’ জানায়।
‘সুমন’ নামের অর্থ ‘সুন্দর মন’ আর আমি চাই তুমি নামের অর্থের মতোই সুন্দর হও, রাজি তুমি?
সুমন মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ সূচক উত্তর দেয়।   

এরপর থেকে এক অদ্ভুত কাহিনী ঘটেছে এখন আর সুমনকে কেউ ‘ভেরেন্ডা ভাজা’ বলে না, বললেও তো ক্ষেপে না। ওইতো ওইদিন মাঠে সুমন ক্যাচ মিস করাতে পাশ থেকে চিৎকার দিয়ে তপু ‘ভেরেন্ডা ভাজা’ বললেও হেসে ব্যাপারটা উড়িয়ে দেয় সে। আজকাল ফার্ষ্ট বয় কি সেকেন্ড গার্ল সবার সাথেই সুমনের খুব ভাব। মেয়েদের সাথে একটু ভাব জমতে দেখলেই হইছে, রেশমি তাকে বকে একাকার করে দেয়। বেচারা গাড়লের মতো সব বকা সহ্য করে যায়।

সমাপ্তি। 

ভেরেন্ডা ভাজা ছোট গল্প বাই মাহতাব হোসেন 

Monday, 9 October 2017

ইশতিয়াক

ইশতিয়াক
একজন গল্পকার
বসে বসে বই পড়ে আর ভাবে।
মাথায় সব সময় গল্প নিয়ে ঘুরে, গল্প লিখে।
দেখা যায় সে যাকে নিয়ে গল্প লিখে তার উন্নতি হয়।
একবার দেখা গেলো এক ভ্যান চালকের দু:খ দেখে, তার সাথে কথা বলে তাকে জানায় তার দু:খ কষ্ট নিয়ে গল্প লিখবে । ভ্যান চালক শুনে খুশী হয়, কেউ একজন হলেও আছে যে তার দু:খ বুঝে। গল্প লিখার কয়েককাল পর ভ্যান চালকের সাথে এক বড়সড় রেস্তোরায় লেখক ইশতিয়াক'র দেখা। ভ্যান চালকের গেটআপ চেহারার মধ্যে আধুনিকতার ছাপ থাকলেও তাকে চিনতে অসুবিধা হয় নি লেখকের। কত কয়েক বছরে একজন ভ্যান চালকের বাহিক্য কাঠামোর এতোটাই পরিবর্তন ঘটেছে যে তাকে দেখে যে কারোই ভূত দেখার মতো অবস্থা হতে পারে, তার উপর শহুরের এই এলাকায় গড়ে উঠা আভিজাত্যে ঢাকা এক অভিজাত রেস্তোরায় বসে আছে সে। লেখক অবাক চেহারায় রেস্তোরায় প্রবেশ করে তাকে দেখে, ভ্যানওয়ালাও আগ বাড়িয়ে তার সামনে চলে আসে; কাছে আসতেই একটু মৃদু হাসে, ছোট করে একটা সালাম দেয়। এসময় লেখক কিছু বলতে যাবে তার আগেই ভ্যানচালক বলে, আপনি আমাকে চিনতে পেরেছেন এই জন্যে নিজের প্রতি গর্ববোধ হচ্ছে। আপনার মতো বড়মাপের লেখক দু পয়সার ভ্যান চালককে এখনো মনে রেখেছেন এর চেয়ে বড় কিছু আর কি হতে পারে। আল্লাহ্‌র কৃপায় আমার অনেক ধন দৌলত হয়েছে কিন্তু আল্লাহ্‌ সবাইকে একসাথে সব কিছুর ক্ষমতা দেয় না, আমার অনেক অর্থ থাকতে পারে কিন্তু আমার মধ্যে শিক্ষা নেই, শিক্ষা বিনা অর্থ যে মরিচিকা তা আমি প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তেই অনুভূব করি। লোকটি একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে কথাগুলো শুনে লেখক একটুও বিস্মিত হচ্ছে না, এক পলকে লোকটির মনের অবস্থা অনুমান করে নিয়েছে। গত কয়েক বছরে লোকটির আর্থিক অবস্থার সাথে সাথে বেশ কিছু চারিত্রিক পরিবর্তনও ঘটেছে। গরিব অবস্থায় লোকটি পাচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতো, জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় থেকেও আল্লাহ্‌ কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করতো, জীবন নিয়ে নিজের মধ্যে কোন অভিযোগ ছিলো না। বর্তমানে তার এই গুণ গুলো নষ্ট হওয়ার সাথে সাথে অনেক দোষও তৈরি হয়েছে, অর্থের মাপকাঠি অনুযায়ী চলতে গিয়ে সমাজের কতো উঁচু তলার মানুষের সাথে তার পরিচয়, সমাজে নিজেকে উঁচু তলার মানুষ বুঝানোর জন্যে গায়ে চরাল চড়া দামে কিনা শার্ট-প্যান্ট, টাই-কোট, আগে যেখানে আল্লাহ্‌র কাছে নিজেকে জাহির করার জন্যে মসজিদে যাওয়া হতো দিনে তিন-চার বার আর এখন উঁচু তলায় নিজেকে জাহির করার জন্যে সময় বের করে সবসময় বারে পরে থাকে। সারাদিন নিজের তৈরি মনগড়া কৃত্রিম দু:খে মশগুল থাকে। দু:খ ভুলবার জন্যে মদ আর নারীকেই গুরুত্ব দিচ্ছে। অথচ গরীর থাকা অবস্থায় নিজের বৌকে নিয়ে কতোই না সুখে ছিলো, অবস্থার উন্নতির সাথে সাথে বৌ'ও গত হয়েছে। সে যে তখন বাপের বাড়ি গত হয়েছে তাকে আর ফেরানোর কোন চেষ্টাই করা হয় নি, বৌ ছিলো বড় অভিমানী স্বামীর আচরণে এতোই কষ্ট পেয়েছে যে বাপের বাড়িতেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়।

লেখক হিসেবে ইশতিয়াকের আলাদা দায়িত্ব আছে, যে ভ্যান চালকের জীবিকার চাকা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্যে তার একটা গল্প লেখা সে চালকের যে জীবনের চাকা ঘুরে দাঁড়াবে সে বা কে জানতো। লেখক নিজেকে নিয়ে আবার ভাবনায় উদয় হলো, এতো অর্থবিত্তে থেকেও যে একজন ভ্যান চালক সুখে নেই সে জন্যে লেখক পুন:রায় সিদ্ধান্ত নিলো লোকটিকে নিয়ে দ্বিতীয় কিস্তির গল্পে লিখবে, যে গল্পের মোত্তাকথা হবে একজন ভ্যানচালকের সাদামাটা জীবন যে জীবনে অভাব আছে, আছে আত্মমর্যাদা, সৃষ্টিকর্তাকে ভয় পাওয়ারও ইঙ্গিত থাকবে, থাকবে শত কষ্টের মাঝেও একমুঠো সুখ।

যে জীবনে একবার চরিত্রের পতন ঘটে সে জীবনে পুনরায় কি চরিত্রের উন্নায়ন ঘটানো যায়? এক্ষেত্রে লেখক ভ্যান চালকের দ্বিতীয় কিস্তির গল্প লিখলেও তার গল্পের বাস্তবতা ঘটতে ব্যর্থ হয়। বাস্তবে দেখা যায় ভ্যান চালক ঠিকই অনেক কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করছে কিন্তু দিন শেষে নিজের উপার্জিত টাকা দিয়ে অন্ন কিনতে না গিয়ে মহল্লায় সস্তায় পাওয়া যায় এমন মদের দোকান খুঁজছে, বেশ্যাপাড়ায় অল্প দামে পাওয়া পতিতাদের নিয়ে ফূর্তিতে মেতে উঠছে আর নেশার ঘোর বেড়ে যেতেই আবোলতাবোল বলে বেড়াচ্ছে, স্রষ্টা আমাকে নিয়ে জুয়া খেলছে, কেনো বা এতো টাকা দিলো কেন বা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিলো!