Wednesday, 13 April 2016

একটি বহু পুরানো স্মৃতি (ছোট গল্প)

প্রকৃতি আসলে নিজ ঢং এ ভাগ্যের খেইলটা দেখায়। না হলে মানুষের জীবনে এতো ভাগ্য সন্ধানী গপ্পো কিভাবে ঘটে যায় তাও আবার গল্প গুলো ইন্টাররিলেটেড। ভাগ্য জিনিষটা আসলে টাকার এপিট ওপিটের মতো। কখনো দু পিট এক সাথে দেখা দেয় না। এক পিঠ দেখতে গেলে অন্যপিঠ হারিয়ে যায়।
এই তো ঘটনাটা বহুকাল আগের না। ইন্টার পাশ করে সবাই ভার্সিটি'র খোঁজে নেমেছে। কে কোথায় ভর্তি হবে সে চিন্তায় নাওয়া খাওয়া নেই নিজেদের মধ্যে। কেউ কেউ তো ভর্তি পরীক্ষার আগের সময় গুলোতে ঘর থেকে বের হতেই চায় না। টানা কয়েক মাস বইপত্র গলদকরন করে পরীক্ষাগারে গিয়ে বমি করে আসে। বমি থেকে বাছাইকৃত উত্তম বমিওয়ালা ই সুযোগ পেয়ে যায় পরবর্তী লক্ষ্যস্থানে পড়ার। সবাই যখন পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত মতি তখন টাকার খোঁজে নামে রাস্তায়। এসে পড়ে সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে ঢাকায়। ঢাকার রাস্তায় রাতেও এতো আলো তারপরেও রাত-দিন গুলো অন্ধকারে ঢেকে ছিলো মতির । মাঝেমাঝে রাজ পথে বর্ষণ না দেখলেও নিজের অন্তজ্বালে কম বেশ স্রোত ভয়ে ছিলো তার। এরই মধ্যে রৌদুরের দেখা মিলে একদিন। জুটে যায় চাকুরিটা।
বেতন বেশী না হলেও দু'মাস যেতে না যেতে চাকুরী পথে আকা বাকা গলি গুলোয় চলতে শিখে নিয়েছে। আকা বাকা গলি দিয়ে হাটতে গিয়ে দেখা গেলো মতির বেতনের তিন গুন টাকা আসতে শুরু করলো মূল টাকা ছাড়াও। তখন প্রথম মাথায় আসে হাতে বড় সুযোগ আছে পরবর্তী কালের জন্যে কিছু করার। সে থেকেই সুযোগি হয়ে উঠে। খোঁজে থাকে চুরি করার। তখন থেকে কাগজে ছাপার সব কিছুর উপর ভাগ ভসাতে শুরু করে মতি। ছাপা খানা থেকে তার বেশী নজর ছিলো কাগজের স্টক আইটেমের উপর। ঝড়-বৃষ্টি, চুরি, নিম্নমানের কাগজ উৎপাদন, নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে প্রতিনিয়ত কাগজের বড় বড় চালান অন্যত্র বিক্রি করে দেয়া হতো নিমিষেই। সরকারী চাকুরী বলে কথা। পোষ্টটা যদিও গরিবী ছিলো; চুরি বিদ্যা জানা না থাকলে মতির মতো তৃতীয় শ্রেনীর কর্মকর্তাদের সাথে প্রথম শ্রেনীর কর্মকর্তাদের মধ্যে তেমন অমিল থাকতো না, বরং এখন কিছু ক্ষেত্রে তারা মতির চেয়ে একটু পিছিয়ে আছে; এমনকি সামাজিক ভাবে না হলেও আর্থিকভাবে ও মতি তার বসদের চেয়ে বেশী সচ্ছল এখন। চালানের টাকা বেশীর ভাগ তার পকেটে গেলেও মাঝে মাঝে বড় কর্তাদেরকে ভিক্ষা দেয়া লাগে। যাকাত না নিলে তাদেরও ভাত হজম হতে চাও না। কারো হজমক্রিয়া খারাপ হলে পরিবেশ খারাপ হতে পারে যে কোন সময়ক্ষনে। তাই নিজ থেকেই পরিবেশ দূষণ মুক্ত রাখার জন্যে মাঝে মধ্যে বড় কর্তাদের একটা খাম ধরিয়ে দিলে তারাও খুশি থাকে। তাদের হাসি দেখে মনে হয় তাদের জন্মই হয়েছে টাকা দেখে হাসি দেয়ার জন্যে। টাকা দেয়া ছাড়া তাদেরকে কোন দিন একটু হাসতে দেখা যায় নি।
আরো কিছু দিন যাওয়ার পর প্রকাশনী করার কথা মাথায় আসলো। নতুন আঙ্গিকে ব্যসবাটা শুরু হলো। টাকা দিয়ে টাকার খেলা তৈরি করা যায়। ছোট থাকতে বড়দের মুখে এ কথাটা অনেক শুনলেও কথাটা আস্তে আস্তে মিলতে শুরু করতে থাকে নিজের সাথে।
টাকার পরিমান অনেক ভাবলেও প্রকাশনী করতে তেমন টাকা খরচ হয় নি মতির। প্রকাশনীতে যতো রকমের র'কাগজের দরকার সব মাস শেষে চলে যেতো সরকারী উৎপাদন কেন্দ্র থেকে। নতুন ব্যবসাটা অল্প দিনেই চাঙ্গা হয়ে উঠে। ব্যবসাটা এই অবস্থানে আশার পিছে গল্পকার রশিদ মামুনের ও অবদান মেলা। প্রকাশনী শুরু করার কিছু দিন পর লোকটা আসে কিছু গল্প নিয়ে। তার চোখে মুখে হাজারো স্বপ্ন; যা দেখে মোহিত হই। গল্প গুলো সময় নিয়ে ছয় দিনের মাথায় পড়ে শেষ করি। গল্প'য় আলাদ তেমন কিছু না থাকলেও ব্যাপারটা হচ্ছে তার লেখুনীর জাদুতে। এরকম লেখা পড়ার পর যে কেউ আনন্দিত হতে বাধ্য তার উপর গল্পের মধ্যে কিছু রসালো কথা আর ঘটনার বিবরনী দেয়া ছিলো। এরকম রসালো কথা যে কোন বয়সে পাঠকের মনে সুড়সুড়ি জাগাতেও সক্ষমতা আনবে। সব কিছু ভেবে তার বইটা ছাপানোতে মতো আসে। এই কথা শুনে রশিদ মামুনের ভালো লাগা দেখে নিজেরও সেদিন ভালো লেগেছিলো। নিজেরর মন কে তখন বুঝা দেয়ার মতো একটা যুক্তিও ছিলো; নিজের স্বপ্ন যেখানে জলে গেছে সেখানে অন্যের বাস্তবায়নটা নিজেকে বুঝ দিতে চাইলো- "নিজের না হয় পারা গেলো না তাতে কি হয়েছে, বরং অন্যের স্বপ্নের বাস্তবায়নের হোতা তো হওয়া গেছে"। পরবর্তীতে রশিদ মামুন তো এখানের হিট গল্পকারের তালিকায় নাম লেখায়। তাকে ছাড়া বই মেলা কল্পনাই করা যেতো না। যা ই লিখতো তা পাঠক শ্রেনী লুপে নিতো। প্রকাশনী ব্যবসা থেকে অল্প দিনে হিউজ টাকা আয় হয়ে যায়। যার পরিমানটা যে কারো কল্পনার বাহিরে ছিলো। এরি মধ্যে এক দিন হুট করে রশিদ মামুন মারা যায় তার মৃত্যুর পর থেকে প্রকাশনী ব্যবসা জিমিয়ে পড়ে। একজন যে রাইটার একটা প্রকাশনীর আয়ের বিশাল উৎস হতে পারে তার নমুনা রশিদ সাহেব রেখে গেলেন। অনেক ভেবে চিন্তে এরি মধ্যে আরো অনেক গুলো ব্যবসায় মনোযোগ বসানো হয়। সবখানেই সাফল্যের গল্প। শুরুটা যতোটা কঠিন ছিলো তার পর থেকে উত্থানের গল্প গুলি ততোটা মামুলি ছিলো।
দিন রাত পরিশ্রম আর ব্যবসায়ের কৌশলের জন্যে আজকে মতিকে প্রথম শ্রেনীর একজন শিল্পপতির তালিকায় রাখা হয়। অর্থের পিছু ছুটতে ছুটতে কখন যে পঞ্চাশ পার হয়ে গেলো একটু টের পাওয়া তো দূরের কথা বয়সটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার মতো কেউ ছিলো না তখন। টাকার পিছে ছুটতে গিয়ে প্রথম জিবনে আত্মীয় স্বজন সব হারিয়েছে মতি। তারপর টাকা বানানোর নেশায় ই কেটেছে সময়। অন্যকিছু নিয়ে ভাবার সময় ছিলো কই তখন। ব্যস্ততা তাকে বিয়ে করার সময় টুকু থেকে ও ভুলিয়ে রেখেছে। বিয়ে না করলেও সে যে বিয়ের আগাম কোন স্বাদ গ্রহণ করেন নি তার নিশ্চয়তা দেয়া মুশকিল। একজন শিল্পপতির আশে পাশে রমনী ঘুরাঘুরি করবে না এরকম তো হওয়ার কথা না। অনেকেই চেয়েছে মতির মনে নিজেকে জায়গা করে নিতে কিন্তু সে অনেক টাকার মালিক হলেও সম্পর্কে ব্যাপারে ছিলো বড্ড আনাড়ি। জৈবিক চাহিদা ছাড়াও যে নারী একটা সম্পর্কের কারন হতে পারে এই ব্যাপারে মতি কোন দিন কিছু জেনে উঠতে পারে নি।
মতির কলেজ লাইফে যে দু চার জন বন্ধু ছিলো তারাও কখনো যোগাযোগ রাখেনি। এতে তার ও কখনো আক্ষেপ জাগে নি, বরং সব মিলিয়ে তার পরেও লাইফটা দিব্বি কেটে যাচ্ছে। এখন অবশ্য মতি ব্যবসা নয়, বরং সমাজ সেবায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায় বেশী। বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা, সেমিনার, অর্থদান, পাঠাগার তৈরি, স্কুল, হাসপাতালের ফান্ড ম্যানেজ করা নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখে চলেছে। তাইতো দিন শেষে নামের আগে যোগ হয়েছে বিশিষ্ট সমাজসেবক বি.মতি চৌধুরী।
আজকে বহু বছর পর নিজ শহরে ফেরা হচ্ছে। এই শহর এক সময় টাকার অভাবে শহর ছাড়া করেছে আর আজ শহুরে মানুষ গুলাকে সাহায্য করার জন্যেই শহরে পা দিচ্ছে মতি চৌধুরী। কতোটা বছর কেটে গেলো শহর ছাড়া। ইন্টারের পর তো এখানে আশা ই হয় নি। মানুষ আসলে অনেক স্বার্থপর না হলে কেমন করে ভাগ্যের পরিবর্তনে বছরকে বছর নিজের নাড়িরটান ছাড়া বহুদূর দেশ-শহরে কাটিয়ে দিতে পারে!
মুগ্ধতা নিয়ে দু নয়ন চোখ জুড়িয়ে নিচ্ছে স্মৃতির শহরটা। স্মৃতিতে তেমন বিঘাত ঘটে নি চোখে। রেখে যাওয়ার শহর তার আগের অবস্থানেই রয়ে গেছে। উন্নয়নের জোয়ার এখানে হানা দিতে পারে নি। স্মৃতি আর বাস্তবের মিশ্র ঘোর কাটতে না কাটতেই চলে এলো তারা শহরের বড় মাঠটায়। গাড়ি দেখে সবাই চেঁচাচেচি শুরু করলো। এই আনন্দের উচ্ছ্বাসও তখন বিরক্তি নিয়ে আসে কানে। আজকে এখানে জন প্রতি দু হাজার টাকা সাথে কিছু ভালো জামা কাপড় বিলি করা হবে। স্টেইজে উঠে যখন দাঁড়িয়েছে মতি তখনও জনতার স্রোতে থাকা মাঝারি সাইজের মানুষটি তার চালার বস্তাটা বার বার দেখে যাচ্ছে। যখন ই বক্তৃতা শুরু হতে যাবে ঠিক তখন ই মাঝারি সাইজের মানুষটির পাশে থাকা বস্তা থেকে চার পাঁচ জন মানুষ মিলে এক সাথে জুতা বের করা শুরু করছে। হঠাত স্টেইজে জুতার বৃষ্টি শুরু হয়। জুতা নিক্ষেপকারীদের মধ্য থেকে মাঝারি সাইজের লোকটা হাক দিয়ে বলে যাচ্ছে- মতি চোরা তুই আজকে সমাজসেবক হইছিস। তুই তো আস্তো একটা চোর চিলি। বাপে তোরে চাকরি লয়ে দিছে তার লগে; তুই তো আমার বাপরে চোর সাজিয়ে তখন বাহির কইরা দিলি। বাপের অপরাধ ছিলো তোরে চাকরি দেয়া, তোর চুরির প্রতিবাদ করা। তোর জন্যে আমার বাপ সে সময় ই শোকে মারা যায়। বাপ আজকে থাকলে তোর এই নাজেহাল অবস্থা দেখে খুশিই হতো। তোর সব তথ্য ই আমার জানা আছে। এতো বছর এই দিনটার জন্যেই অপেক্ষায় ছিলাম। এতো জোরে হাক দিলেও জনতার স্রোতে কথা গুলো বেশী দূর জেতে পারে নি। এরি মধ্যে পুরো স্টেইজ খালি হয়ে গেছে। মতি চৌধুরী পালিয়ে চলে যায়। স্টেইজে থাকা বড় বড় বাক্স আর টাকার বাণ্ডিল গুলো নিয়ে মানুষের মধ্যে কাড়াকাড়ি মারামারি চলছে। অল্পক্ষনে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাহিরে চলে যায়।
হার্টে সমস্যা থাকাতে মতি চৌধুরী ড্রিংকস করা বহু আগে ছেড়ে দিয়েছে। তারপরেও আজকে বহুদিন পর অর্ধেক বোতল এক বসায় গিলে নিয়েছে। তবুও আজকের স্মৃতি ব্রেইন থেকে সরে যাচ্ছে না। ড্রিংকস করার পর থেকে মনে হচ্ছে দিনের মুহুর্ত গুলো এখনো চোখের সামনে খেলা করছে। এই রকম অপমান সে একবারেই সইতে পাচ্ছে না। ড্রিংকস,সিগারেট কিছু কাজে দিচ্ছে না এখন। মানুষের মুখে কতো শুনেছে এরকম মুহূর্তে এই বস্তু গুলো মহাওষুধী হিসেবে কাজ করে। এতো খাওয়ার পরেও নিজেকে এখনো দিব্বি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। সবকিছু নিয়ে এখন রাগে মাথা থেকে পা পর্যন্ত গিজগিজ করছে শরীর। চোখের সামনে এখান যা ই পড়ছে তা ভাঙ্গলেও দিনের মুহুর্তগুলো ভুলার নয়। আবার বোতলটা সামনে নিয়ে বসলো মতি। পুরো বোতল শেষ করার পর পাশে থাকা ড্রয়ারে বা হাত ঢুকিয়ে কালো কালারের ছোট বস্তুটা বের করে দেখতে শুরু করলো।কালো হলেও বস্তুটা চকচক করছে। বস্তুটা দেখা শেষে চারদিকে এক নজর তাকাতেই চোখ টলমলিয়ে উঠলো। আস্তে আস্তে আবছা অন্ধকার দেখা শুরু করলো। বুঝতে অসুবিধে হয় নি এটা যে এক বোতল পানি হজম করার প্রতিক্রিয়া। টলমলে অবস্থা থেকে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বা হাতে থাকা বস্তুটা হাত থেকে মুখে পুরে নিলো। হঠাত বিকট আওয়াজ হতে ই মতি চৌধুরী ফ্লোরে লুটিয়ে পড়েন। আস্তে আস্তে রক্তে পুরো ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে।
ঘড়িতে সকাল পাঁচটা বাজে। টেবিলে থাকা ছোট ঘড়িতে এঁটে থাকা জোকার মুখায়বটা হেসে যাচ্ছে ঘন্টির তালে তালে। ঘড়ি ঘন্টি বাজাচ্ছে; তার কি আর বুঝ আছে নাহলে সেও আজকে থেকে ঘন্টি বাজানো বন্ধ করতো।
মাহতাব হোসেন
১৪-০৪-১০১৬

No comments:

Post a Comment