উজান
বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছে, সব রুটের
বাসের আনাগোনা খুব কম আজকে, সে হিসেবে তার রুটের বাসের অবস্থা আরো করুণ। যেন অপেক্ষার পর্ব শেষ হতে চায় না।
তার মতো আরো অনেকেই আশেপাশে জড়ো হয়েছে দিন শেষে বাসায় যাওয়ার জন্যে কিন্তু বাসের অপেক্ষা তাদেরকে বেকুল করে তুলেছে।
এ মরা শহরে সবকিছু মরে মরে হয়।
কোথাও গতি নেই।
শুধু রাস্তা ফাঁকা হলেই হলো, মরা শহরে গতিহীন বাস গুলো তখন গতি দানব হয়ে উঠে।
বাস চালকরা ফিরে পায় পৈত্রিক যৌবন।
প্রতিযোগিতায় নাম লেখার নিজেদের মধ্যে, এমন প্রতিযোগিতায় কোন মৌখিক বা লিখিত বার্তার প্রযোজনা নেই।
নিজেদের মধ্যে একটু চোখাচোখি হলেই হলো, অনেক সময় তার ও প্রয়োজন
হয় না।
ফাঁকা রাস্তা দেখে কেউ জোরে টান দিল, এ দেখে বাকি ড্রাইভাররা সইতে পারে না তখন যৌবনের সুরসুরি শুরু হয়ে যায়,
লেগে যায় পাল্লা, কে কার আগে যাবে এ নিয়ে হুড়াহুড়ি, কোথায় কি আছে সে নিয়ে ভাবার কিছু নেই,। বাসের
ভেতরের যাত্রীদের চিৎকার শোনার সময়ও নেই; যাত্রীরা সব সময়েই চিল্লায়, হুদাই চিল্লায়।
তাদের পাত্তা দেয়াটা বড় কোন ইস্যু না। পরে দেখা যায় নিজেদের যৌবন দরে রাখতে না পেরে বাস রাস্তা ছেড়ে ফুটপাতে বা রাস্তার পাশে ডোবা-নালায় নামিয়ে দেয়।
তারপর ড্রাইভার বেঁচে থাকলে জনগনের ধোলাই থেকে বাঁচার জন্যে পালায়৷
অনেক্ষণ
হয়ে গেল তবুও বাস আসার কোন লক্ষণ নেই।
চাইলে উজান অন্য বাসেও যেতে পারতো।
অন্য রুটের বাসে গেলে নানান সমস্যা।
বার বার বাস পাল্টাতে হয়।
খরচের খাতাও বেড়ে যায় অনেক, সবচেয়ে বেশী সমস্যা হচ্ছে দিন শেষে এত ক্লান্তি নিয়ে বার বার মানুষের সাথে যুদ্ধ করে বাস পালটিয়ে বাসায় যাওয়াটা, খুবই অশান্ত।
এমন অশান্তির চেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ দেখা অনেক ভালো।
তাতেও অনেক মজাদার ব্যাপার লক্ষ করা যায়।
একটু আগেও যে মজার ঘটনাটা ঘটেছে দাঁড়িয়ে না থাকলে তা দেখা যেত না।
উজান
থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে বাপ-ছেলে।
একটু দূরে হলেও তাদের কথাবার্তা এখন থেকে শোনা যায়, তাদের মধ্যে আলাপটা উজানের কাছে মজার মনে না হলে সেদিকে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকতো না,
তখন মনোযোগ শুধু বাসের দিকেই থাকতো।
পাশে থাকা ছেলেটি বাবাকে দেখিয়ে বলছে, 'বাবা বাবা আমাকে একটা বল কিনে দাও, বড় বল
গুলার একটা'। তার বাবা এ কথা শুনে খুব বিরক্ত তবুও বিরক্তি না লুকিয়ে
বলে উঠে, 'তোর মতো এটুকু বয়সে ভয়েও বাপের সাথে কথা বলতাম না, আর তুই
এতোটুকু বয়সে ফালতু আবদার করা শিখে গেছিস, আমার সাথে আসছিস চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবি আর আমি যা করি তা দেখবি এর বাহিরে কিছু করলে ফুটবলের মতো শট দিবো'। এ কথা শুনে ছেলে দমে গেলেও চেহারায় না পাওয়ার ক্ষোভ আর বাপের কথায় যে কষ্ট হচ্ছে তা চেহারায় ঠিকই লেপ্টে
আছে।
একটা কঠিন ঝাড়িতেই কাজ হয়েছে তা ভেবে ছেলের বাবা মনে মনে স্বস্তি ফিরে পেয়েছে কিন্তু এতো কড়া কথা বলাতে নিজের মধ্যে এখন অন্যরকম ফিল হচ্ছে।
হুট করে শরীরে প্রচন্ড রকম নিকোটিনের অভাব অনুভব শুরু হয়েছে।
এটুকু ছেলের সামনে খাওয়া উচিৎ হবে না জেনেও পাশে থাকা একটা চোকরার কাছ থেকে সিগারেট চায়।
বাবাকে সিগারেট টানতে দেখে ছেলে আবার বায়না দরে, নিজেও সিগারেট খেতে চায়৷ তখন বাবাকে মনে করিয়ে দিলো,
তুমিই একটু আগে বললা তুমি যা করবা আমাকেও তা করতে'। ছেলের এমন কথা শুনে বাবা আমতা আমতা করে সিগারেটটা ফেলে দেয়৷ আর ছেলের জামা টেনে নিয়ে সামনে হাটা দেয়। নিজের মনে মনে রাগে গিজগিজ করতে থাকে, 'এমন এক হাজামজাদা জন্ম দিছি এখন থেকেই যা জ্বালাচ্ছে বড় হয়ে তো মাথা খাবে'।
উজানের আর সহ্য হচ্ছে না।
নিজের রুটের বাস আসার আর কোন লক্ষন দেখছে না।
অপেক্ষা করতে করতে এখন অনেক ক্লান্তিবোধ হচ্ছে, একঘন্টার উপর একটা বাসের অপেক্ষায় থাকার পরেও যখন বাস আসে না, তখন বলাই যা বাসটা
তার প্রতি জুলুম করেছে।
এমন জুলুম মেনে নেয়ার না; দেরীও আর সহ্য
হওয়ার না।
অন্য রুটের বাস আসার সাথে সাথেই বাসে উঠে পড়েছে উজান।
মাঝপথে নেমে তাকে আবার অন্য বাসে উঠতে হবে, তখনও বাসের দেখা না পেলে
রিকশায় বাকি পথ যেতে হবে।
অবশ্য সেখান থেকে বাসে উঠা আরো কঠিন ব্যাপার, তার চেয়ে রিকশায় বাসায় যাওয়া বেশী স্বস্তিকর।
সারাদিনের
ক্লান্তি তাকে স্বস্তি দিয়েছে তখন বাসে উঠে নিজের জন্যে একটা ফাঁকা সিট দেখতে পায়।
তার ভাগ্য ভালো একজন পরে উঠলেও খালি সিটা ফাঁকা থাকতো না।
উজান এর পরে যারা উঠছে সবাইকেই দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে; দাঁড়ানো অবস্থায় একজন
বৃদ্ধ লোকও রয়েছেন।
বাপের বয়সের এমন লোককে বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার নিজের মধ্যে মায়া জন্মায় খুব, সব সময় ই এমন
মায়া হয়।
কিন্তু নিষ্টুর এই পৃথিবীতে এমন মায়াকে নিয়ন্ত্রন করতে হয়। এমন ভাবলে নিজের জন্যে নিজেকে বুঝ দেয়া যায়। ঠিক ঠাক ভাবে
এ মুহূর্তে নিজেকে
বুঝ না দিতে পারলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তখন বিবেকের তাড়নায় বৃদ্ধকে সিটে বসতে দিতে হবে।
এমন অনেক কথাই তার মনে ঘুরলেও নিজের ভাবনা গুলোকে ঝেরে ফেলে সিটের মধ্যে নিজের মাথা এলিয়ে দেয় আর চোখ বন্ধ করে, চোখ বন্ধ করার আগ মুহুর্তে
বৃদ্ধের সাথে চোখাচোখি হয়; মায়াভরা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে উজানের দিকে।
যেন কিছু বলতে চায় বৃদ্ধ তাকে।
কিন্তু এ শহরে কার এতো সময় অন্যের চোখের ভাষা বুঝে, তাকে জিজ্ঞাস করার-
'আপনি
কি আমাকে কিছু বলতে চান' তখন ওপাশ থেকে
'না'
উত্তর আসবে তাতেও ধৈর্য্যহীন না হয়ে আবার তাকে জিজ্ঞেস করা হবে, 'কিছু মনে করবেন না আপনার চাহনি দেখেই বুঝা যায় আপনি কিছু বলতে চান' তখন লোকটা আর কিছু
বলতে পারবে না, নিজেকে লুকাতে না পেরে
আমতা আমতা করে বলে দিবে নিজের মনে লুকিয়ে থাকা যতো কথা, যেগুলো কাউকে শেয়ার করতে চেয়েছিলো কিন্তু মনের মতো কাউকে এতোদিন শেয়ার করা যায় নি।
ছোট গল্প
মানবের শহর
মাহতাব হোসেন।
No comments:
Post a Comment