আরজ আলী মাতুব্বরের জন্ম ১৯৯০ সাল। ছোট বেলা থেকে তার বই পড়া আর জানার খুব ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু সব ইচ্ছা
তো ইচ্ছানুযায়ী হয় না। সব কিছুর জন্যেই সময় আর অবস্থার প্রয়োজন লাগে। মাতুব্বরের ইচ্ছা আর অবস্থায় চাওয়া ভিন্ন ছিলো। তারপরেও সে নিজের জানার ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখে নি। দূর-দূরাত্বের যেখানেই বইয়ের খোঁজ পেতো ছুটে যেতো বই পড়ার জন্যে।
কৈশোর শেষ করে যৌবনে পা দিতেই তার মায়ের মৃত্যু হয়। জন্মের চার বছর পর জনক বিহীন মাতুব্বরকে তা মা ই বড় করে তুলেন। জননীর এই বিযোগ তার মনকে খুবই ব্যাথিত করে একই সাথে মায়ের স্মৃতিকে ধরে রাখতে স্মৃতি হিসেবে মায়ের মৃত ছবি তুলে রাখার ইচ্ছা জাগে মনে। ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করে মাতুব্বর কিন্তু গলদ বাঁধে গ্রামের মোল্লা সমাজে। মাতুব্বরের এই ইচ্ছাকে তারা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারেন নাই যার দরুন তারা তার মৃত মায়ের জানাজা আর দাফন করতে কোন ভাবেই রাজি হয় নি। মৃত ব্যক্তিকে রেখে তারা স্থান ত্যাগ করেন। লাশের অপরাধ ছিলো আরজ আলীর এক খানা ছবি তোলা।
এমন নিষ্টুর আচরণ আরজ কোন ভাবেই মেনে নিতে সক্ষম হয় নি নিজ মনে। সে বার বার মোল্লা সমাজকে বুঝিয়েও ব্যর্থ হয়। তার কথা হলো, মৃতের ছবি তুলে যদি অন্যায় করে থাকি তাহলে তা তো আমি করেছি তার জন্যে আমার মৃত মা সাঁজা পাবে কেনো? এই জন্যে যদি কোন গুনাহ হয়ে থাকে তার দায় আমি নিতে প্রস্তুত তারপরেও কেনো আপনারা আমার মায়ের জানাজা পালন করবেন না। আমার মা ফরহেজগার বান্দা ছিলেন আমার জন্যে সে কেনো জানাজা ছাড়া কবরে যাবে। শত রকম বুঝিয়ে ও সে তখন ব্যর্থ। তাকে আর তার মৃত মাকে রেখে গ্রামের সকলে যখন চলে যায় তখন বাধ্য হয়ে আরজ তার চেনা জানা দু-তিন জনের সাহায্য নিয়ে জানাজা ছাড়াই মায়ের কবর দেয়। এমন যন্ত্রণা পরবর্তীতে তার নিজের চিন্তার জগতের রাজ্য পরিবর্তন করে।
এতো কিছুর পরেও আরজ আলী মৃত মায়ের ছবি খানা নিজের মধ্যে রেখে দিয়েছেন। ওই দিনের ঘটনা তার বিবেকে টনড় নাড়ে। এর সাথে যুক্ত হয় তার দেখা আর চিন্তার ব্যাপক পরিবর্তন। সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী বয়সের পরিপক্বতা আসে আরজ আলীর। সাথে আসে চিন্তারও ব্যাপক পরিবর্তন। বহু বছরের পড়া বই সমূহ, সমাজ-সমাজের মানুষ, তাদের চিন্তা চেতনা নিয়ে ভাবা এবং সেই অনুযায়ী নিজের মতাদর্শ তৈরি করে- এক দিন আরজ আলী নিজেকে স্বশিক্ষিত করে এবং সে থেকে তার চিন্তায় দর্শনের প্রকাশ ঘটে। এই ভাবেই একজন গ্রামের চাষাভুষা কৃষক সমাজ দর্শন চিন্তাবিদ হিসেবে গড়ে এই বাংলায়।

No comments:
Post a Comment