ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। হ্যারিকেনের আলোয় পুরো ঘর জুড়ে অলৌকিক আভা। যেনো রূপ কথার কোন এক রাজ্যে শান্তির এক নীড়। যে নীড়ে বৃষ্টি আশীর্বাদ হিসেবে নেমে এসেছে।
টিন আর কাঠে তৈরি ঘরে লোহার শিক দিয়ে বানানো জানালা। ঘরের সম্মুখ জানালার পাশে বসে আছে রাত্রি। হ্যারিকেনের আলোও তাকে অনেক মায়াবী দেখাচ্ছে। যেনো পারস্য দেশের কোন এক ড্রামা সিরিয়ালের নাকিয়া।
টিনের চালে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি স্রষ্টার নেয়ামত। নেয়ামতে অদ্ভুত সৌন্দর্য। বৃষ্টিতে চারদিকে রিমঝিম শব্দ খেলে। টিনের চালে টুপ টুপ শব্দ। মায়াবী মেয়েটা যেনো কোন এক মায়াবী রাজ্যে হারাতে চায়। কিন্তু কোথাও জেনো তার সব কিছু থেমে রয়েছে।
রাত্রির দৃষ্টি সামনে বারান্দা পেরিয়ে বাড়ির মাটির উঠোনে। তাদের বারান্দাটা অনেক সুন্দর। মায়ের হাতে বানানো মাটি লেপে তৈরি করা বারান্দা। আগে তারা প্রায় রাত্রি বেলায় এই বারান্দায় পাটি পেতে গল্প করতো। বাবা ছিলো তাদের গল্পের মূল আর্কষণ। বাবা কতো রকম গল্পই না শুনাতো তাদের। বাবার গল্প বলার ভঙ্গি দেখে রাত্রির মনে রাত্রি বেলায় কতোই না ঈর্ষা হতো। মনে মনে তখন কতোই গল্প বানাতো। বাবাকে শুনাবে বলে কতো রকম ভাবেই না গল্প বানাতো। সবই অতীত, সবই সোনালী দিন। আচ্ছা, সুখের সীমানা অনেক ছোট হয় নাকি সময়ের স্বল্পতা ব্যক্তি নিজেই নির্ধারণ করেন?
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমেছে। ছোট এই নীড়ে সব কিছুই আছে। আছে সুখ, আছে ভালোবাসা, এখানে মায়ার বাঁধন খুবই অটুট। অল্পতেই সবাই একে অন্যের জন্যে মরীয়া হয়ে পড়ে। তারপরেও এই সুখের নীড়ে বৃষ্টি ভেজা রাতে কিছু একটা কমতি খেলে। রাত্রির চোখে তাকালে সে কমতি কেউ উপেক্ষা করতে পারবে না।
হ্যারিকেনের আলো রাত্রির কামরা পেরিয়ে উঠোনে ঠেকেছে। হ্যারিকেনের রঙ্গিন আলোয় উঠনে পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা গুলোকে কতোই না সুন্দর দেখাচ্ছে। বৃষ্টির ফোটায় পলি জমা মাটি গুলোও কতো আগেই ক্ষত ধরেছে। প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা মাটির বন্ধন ছিঁড়ে ভিতরে ক্ষত তৈরি করেছে। বের হচ্ছে মাটি থেকে গাড় রঙের বেদনা। বেদনা গুলো মাটির সাথে পানির স্রোতে দূরে কোথাও গিয়ে ঠেকছে। এভাবে, নতুন ভাবে নতুন স্থানে নতুন করে গড়ে উঠবে মাটিদের আরেক বসতি।
এই অপরূপ বৃষ্টিও আজ রাত্রির চোখে সৌন্দর্য দেখাতে ব্যর্থ। এই রাত্রিই এককালে কতো করে চাইতো বৃষ্টি মাখা সময়ে নিজের হিরোকে নিয়ে জানালার পাশে বসে গল্প করবে। যে গল্পে বাদ যেতো না কিছুই। মাঝে মাঝে তারা চা খেতো আর বৃষ্টির পড়ার এই ব্যাপার স্যাপার নিয়ে নিখুঁত আলাপ করতো।
বৃষ্টিরা কেনো আসে, কেনো যায়। বৃষ্টি আসলে লোকালয়ের সুবিধা কি বা অসুবিধা কোথায়। কোন কিছুই বাধ যেতো না আড্ডায়। অথচ আজ অবধি বৃষ্টি হচ্ছে কিন্তু এ বৃষ্টি রাত্রির মনে তাড়না কাজ করাতে সক্ষম হচ্ছে না। বৃষ্টি হলে সে এখনও জানালায় পাশে বসে। এটা ভালোবাসার খাতিরে না, অভ্যেসের দায় থেকে।
কোন এক ঝড়ের রাতে যে মানুষটির গল্প করার কথা ছিলো তা না করে বরং রাত্রিকে বিদেয় জানিয়ে চলে যায়। চলে যায় না ফেরার দেশে। রাত্রি কোন ভাবেই তার হিরোকে ভুলতে পারছে না। কি রকম ব্যথাতুর হৃদয় হলে একটা কোমল মন প্রকৃতির নিয়মকে মেনে নিতে অপরাগত জানায়।
গ্রামের অন্য সব মেয়ের মতোই বেড়ে উঠতে পারতো রাত্রি। কিন্তু উদার আর আধুনিক জ্ঞানসম্পন্ন বাবা করিম উদ্দিন কোন ভাবেই চায় নি তার মেয়ে অন্য সব গ্রামের মেয়ের মতো বেড়ে উঠুক।
প্রকৃতি যেখানে মানুষকে উদার হয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে সেখানে গ্রামের মানুষদের মনে ভূত বাসা করে রেখেছে। তারা প্রকৃতির এই কৃজ্ঞতাকে উপেক্ষা করে নিজেদের মতো একটা সর্কীণ্ণ সমাজ গড়ে তুলেছে। যে সমাজে কোন কিছুর ই ঠিক নেই। ডর, ভয়, কুসস্কার, ভণ্ডামি, ধর্মীও গোঁড়ামি এই রকম ছেলে-খেলা ব্যাপার গুলো সমাজের মূল মন্ত্র হিসেবে ঠাই করে নিয়েছে।
করিম উদ্দিন সমাজের এমন ব্যাপার গুলোর উর্ধে। নিজের সন্ত্রান বা স্ত্রীকে এমন ব্যাপার গুলো থেকে দূরে রেখেছে। এই নিয়ে সমাজে তাকে নিয়ে কম কানাঘুসা হয় নি। অনেকে তো আড়ালে তাকে পাগল বলেও তিরস্কার করতো।
ঝড়ের রাতে রাত্রির বাবার মৃত্যুকে সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তিরা স্বাভাবিক ভাবে দেখে নি। তাদের মতে আল্লাহ্’র গযব পড়েছে তার উপর। কানাখোসা কথাগুলো রাত্রি কিংবা তার মায়ের কানেও এসেছে। মানুষের এমন আচরণে তারা মোটেও দুঃখ পায় নি। যারা এমন অসুস্থ মন-মানুষিকতা নিয়ে ঘুরছে তাদের প্রতি রাত্রির মনে চরম সমবেদনা রয়েছে।
করিমের মেয়ে তার প্রায় সব কিছুই পেয়েছে। কথা বার্থা, চেহানা, আচার ব্যবহার। এই নিয়ে আল্লাহর কাছে রাত্রি খুবই কৃতজ্ঞ। মাঝে রাতে প্রার্থনা শেষে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞা প্রকাশ করে। তার নিজের মাঝে মাঝে মনে হয়, “বাবা বুঝি নিজে চলে গিয়ে তাকে রেখে গেছে বাবার প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে”।
আজকের এই বৃষ্টিভেজা পরিবেশ তার মনে কোন উচ্চাশা জাগাতে পারে নি। রাত্রির মন এখনও ব্যথাতুর হয়ে আছে। মনের গহীনে কোথাও যেন বৃষ্টি হচ্ছে। এই বৃষ্টির উৎস কোথায়, তা কারো জানা না থাকলেও বৃষ্টির কারনটা যে তার হিরো এটা না বুঝার মত ব্যক্তি একজনও নেই স্রষ্টার এই জগতে।
মাহতাব হোসেন
১১ মার্চ, ২০১৭
রাত ১টা ৫০ মিনিট।
মাহতাব হোসেন
১১ মার্চ, ২০১৭
রাত ১টা ৫০ মিনিট।

No comments:
Post a Comment